হৃদরোগের ইতিবৃত্ত
ডা. এসএম হাবিবউল্লাহ সেলিম, হেলথ নিউজ | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:০৯ | আপডেটেড ১ অক্টোবর ২০১৮, ০৪:১০
বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে হৃদরোগ একটি আশঙ্কার নাম। হৃদযন্ত্রজনিত রোগের মধ্যে করোনারি হার্ট ডিজিজ অথবা ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ এবং স্ট্রোক বিশ্বের এক নম্বর ঘাতক হিসাবে চিহ্নিত।
হৃদরোগের অনেক কারণের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও রক্তনালীতে চর্বি জমে যাওয়া প্রাধান কারণ। সাথে সাথে বয়সের সাথে হৃৎপিণ্ড ও ধমনীর গঠনগত পরিবর্তনও হৃদরোগের জন্য অনেকাংশে দায়ী।
বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রতি বৎসর প্রায় ১ কোটি ৭৩ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে হৃদরোগে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে ২ কোটি ৩০ লাখে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও এই রোগ ক্রমেই বেড়ে চলছে। বাংলাদেশ হেলথ বুলেটিন ২০১৩ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগের মৃত্যুর হার প্রায় ১২.২ শতাংশ।
এজন্য প্রতি বছর ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের উদ্যোগে ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একই সাথে হৃদরোগ প্রতিরোধ বিষয়ক সচেতনতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এ বৎসর প্রতিপাদ্য হল- ‘আমাদের হার্ট আমাদের অঙ্গীকার’।
এই প্রাণঘাতী রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে জানতে হবে আমাদের সবাইকে।
হৃদরোগের ঝুঁকিগুলো
‘ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ’ তথা হৃদরোগের প্রধান কারণ হল কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য চর্বিজাতীয় পদার্থ’ রক্তবাহী করোনারি ধমনীর অভ্যন্তরে জমা হওয়া, যার ফলে অবরোধের সৃষ্টি এবং ওই ধমনীগুলি দিয়ে রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে। কতগুলো অবস্থা এবং জীবনযাপনগত কয়েকটি অভ্যাসকে চিহ্নিত করা হয়েছে এই কোলেস্টেরল এবং চর্বি রক্তবাহী নালীর মধ্যে জমা হওয়ার জন্য এবং উচ্চ হারে সঞ্চয় বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য। এগুলিকে ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান বলা যায়।
পরিবর্তনশীল ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান
এই শ্রেণিতে সেই উপাদানগুলো আসতে পারে, যেগুলো পরিবর্তন করা যায় এবং প্রতিরোধ করা যায়। যার ফলে হৃদরোগের বৃদ্ধিকে থামিয়ে রাখা যায় এবং সম্পূর্ণ সুস্থ করা যায়।
** ধূমপান বা তামাকজাত দ্রব্য সেবন
** উচ্চ রক্তচাপ
** ডায়াবেটিস
** মেদাধিক্য বা দৈহিক উচ্চতা অনুসারে বাড়তি ওজন
** রক্তের মধ্যে উচ্চ কোলেস্টেরলের মাত্রা
অপরিবর্তনীয় ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান
এই শ্রেণিতে তিনটি উপাদান আছে, যেগুলো পরিবর্তন করা যায় না এবং যারা আগেভাগেই ব্যক্তি বিশেষকে হৃদরোগপ্রবণ করে তোলে।
** বয়স
** লিঙ্গ
** বংশগত বৈশিষ্ট্য
হৃদরোগের লক্ষণ
** ‘এ্যাঞ্জাইনা’ বা হৃদরোগজনিত বুকে ব্যথা হচ্ছে একটা ভারী চাপ অথবা ব্যথার অনুভুতি, যা বুকের মধ্যখানে অথবা বাম দিকে অনুভূত হয় এবং বাম হাতে প্রসারিত হয়। তবে হার্ট এ্যাটাকের ব্যথা খুবই তীব্র হয়
** শ্বাসহীনতা বা স্বল্পশ্বাস (শ্বাস কষ্ট)
** ঘর্মাক্ত হওয়া
** বমি-বমি ভাব এবং বমি করা
** মাথা ঘোরা এবং অজ্ঞান হওয়া
** অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের পর বুকে ব্যথা বা চাপ
** গলায় অনুভূতি হারানো
** বুকে কিংবা ওপরের দিকের পেটে চাপ অথবা টানটান ভাব
** দুর্বলতা এবং সহজে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়া
** দৈহিক অসাড় ভাব
এই লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং ইসিজি করতে হবে।
হার্ট অ্যাটাক
বুকের ব্যথা বা ‘এ্যাঞ্জাইনা’র ব্যথা সেই সময় প্রকাশ পায়, যখন ধমনীর অভ্যন্তরের ফাঁকা অংশের ৭০% অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এই অবরোধগুলো বেড়ে ওঠে শতকরা ১০০% ভাগ হয়ে গেলে শুরু হয় তীব্র যন্ত্রণা, ঘাম দেওয়া এবং শেষ পর্যন্ত হৃদপিণ্ডের কিছু অংশের পেশী অকেজো হয়ে স্থায়ীভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। একে হার্ট অ্যাটাক বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় মায়োকার্ডিয়াল ইন্ফারক্সন বলা হয়।
হৃদরোগ সব বয়সেই হতে পারে। তবে সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিরাই এ রোগের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। প্রজননে সক্ষম নারীর তুলনায় পুরুষদের হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
হৃদরোগ চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
হৃদরোগ চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য ঝুঁকিগুলো প্রতিকার করা, যা ওষুধ ও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব। জটিল হৃদরোগের ক্ষেত্রে ওষুধের পাশাপাশি কখনও রিং অথবা বাইপাস অপারেশনের প্রয়োজন পড়তে পারে। এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা এড়ানো সম্ভব, যদি নিজে সচেতন হই এ পরিবার ও সমাজকে সচেতন করে তুলি।
প্রতিরোধের উপায়
** ঘরে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য নিশ্চিত করুন। যেমন ফাস্ট ফুড, প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য, তেল-চর্বি জাতীয় খাদ্য, অতি লবণ ও অতি মিষ্টি খাদ্য বর্হন
** তাজা ফল-মূল, শাক-সবজি বেশি খাওয়া
** অফিস এবং স্কুলের জন্য বাসায় তৈরি স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ
** বাসগৃহে সব ধরনের ধূমপান, তামাক, জর্দা-গুল বন্ধ রাখা
** প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০মিনিট হাঁটা কিংবা ব্যায়াম করা
** পরিবারের সকলের রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তের চর্বি, শরীরের ওজনর দিকে নজর রাখা, নিয়মিত পরীক্ষা করা
ইতোমধ্যে যদি কোনো হৃদরোগে আক্রান্ত না হয়ে থাকেন তবে পরবতী ১০ বছরে নিজের হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞর তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার (যেমন- ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, ইটিটি, বায়োকেমিক্যাল টেস্ট, করোনারি এনজিওগ্রাম) মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে। ঝুঁকি অনুসারে সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাকজনিত মৃত্যু প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
সচেতনতা তৈরি করা
** সকলের জন্য স্বাস্থ্যকর হৃদবান্ধব পরিবশ সৃষ্টি করা
** রেডিও – টেলিভিশনসহ সকল প্রচার মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রচার-প্রচারণা বৃদ্ধি করা। ধূমপান, ফাস্টফুড, কৃত্রিম ও প্রক্রিয়াজতকৃত খাদ্যের বিজ্ঞাপন সীমিত করা এবং এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সকলকে সচেতন করা
** পাঠ্যসূচিতে হৃদরোগের ভয়াবহতা ও সচেতনতামূলক স্বাস্থ্য বিষয়ক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা
** হৃদরোগ চিকিৎসা সহজলভ্য করার লক্ষ্যে সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে হৃদরোগ চিকিৎসার সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা
আসুস সবাই এই বিশ্ব হার্ট দিবসে কীভাবে হার্টকে সুস্থ ও গতিময় রাখা যায়, সে ব্যপারে এক অন্যের সাথে আলোচনা করি এবং হৃদবান্ধব হিসেবে গড়ে উঠতে সচেষ্ট হই। এই রোগ প্রতিরোধ শুধু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বা সাধারণ চিকিৎসকদের মাধ্যমে সম্ভব নয়। সমন্বিতভাবে সবাই চেষ্টা করলে আমরা ২০২৫ সালের মধ্যে হৃদরোগে অকাল মৃত্যুর সংখ্যা কমপক্ষে শতকরা ২৫ ভাগ কমিয়ে আনতে পরি।
তাই বিশ্ব হার্ট দিবস আসুন প্রতিজ্ঞা করি- স্বাস্থ্যকর উপায় খাবার খাব, ধূমপানকে না বলব, কর্মঠ থাকব।
এই অঙ্গীকার আমার, আপনার, সকলের হার্টের জন্য। আসুন আমরা সবাই মিলে ব্যক্তিগত সামাজিক এবং জাতীয় উদ্যোগের মাধ্যমে হৃদরোগ প্রতিরোধ কাজ শুরু করি।
[ডা. এসএম হাবিবউল্লাহ সেলিম, এমবিবিএস, ডি-কার্ড (লন্ডন), এমডি (কার্ডিওলজি; সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ,
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল; সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটি; সাধারণ সম্পাদক, সিলেট হার্ট অ্যাসোসিয়েশন]
বিষয়: special4
নোটিশ: স্বাস্থ্য বিষয়ক এসব সংবাদ ও তথ্য দেওয়ার সাধারণ উদ্দেশ্য পাঠকদের জানানো এবং সচেতন করা। এটা চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নয়। সুনির্দিষ্ট কোনো সমস্যার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই শ্রেয়।
স্বাস্থ্য সেবায় যাত্রা শুরু
আঙুর কেন খাবেন?
ছোট এ রসালো ফলটিতে আছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, খনিজ ও ভিটামিন। আঙুরে রয়েছে ভিটামিন কে, সি, বি১, বি৬ এবং খনিজ উপাদান ম্যাংগানিজ ও পটাশিয়াম। আঙুর কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা ও হৃদরোগের মতো রোগ প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
সব টিপস...
চকলেটে ব্রণ হয়?
এই পরীক্ষাটি চালাতে গবেষকরা একদল ব্যক্তিকে এক মাস ধরে ক্যান্ডি বার খাওয়ায় যাতে চকলেটের পরিমাণ ছিল সাধারণ একটা চকলেটের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। আরেক দলকে খাওয়ানো হয় নকল চকলেট বার। চকলেট খাওয়ানোর আগের ও পরের অবস্থা পরীক্ষা করে কোনো পার্থক্য তারা খুঁজে পাননি। ব্রণের ওপর চকলেট বা এতে থাকা চর্বির কোনো প্রভাব রয়েছে বলেও মনে হয়নি তাদের।
আরও পড়ুন...
ভিটামিন ডির ঘাটতি পূরণে কী করণীয়?