Site icon Health News

দেশে খাদ্য উৎপাদন-অপুষ্টি দুটোই বেড়েছে

স্বাধীনতার পর দেশের প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে। এরপরও অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে চার লাখ।

চলতি বছর প্রকাশিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি প্রতিবেদন ও বৈশ্বিক কৃষি পরিসংখ্যান প্রতিবেদন এবং দুটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার তৈরি করা বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যতালিকায় নতুন খাবার যুক্ত হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, খাদ্যশক্তি গ্রহণের দিক থেকে বাংলাদেশ গত ২০ বছরে ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করছে।

১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে ২ হাজার ২৮৫ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি গ্রহণ করত। আর এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫১৪। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটান বাংলাদেশের চেয়ে খাদ্যশক্তি গ্রহণে এগিয়ে আছে।

পুষ্টিকর খাবার
এফএওর ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের মোট খাদ্যশক্তির ৮৩ শতাংশ আসত দানাদার খাদ্য থেকে। অর্থাৎ ভাত, ডাল ও গম থেকে। যার বেশির ভাগই শর্করা জাতীয় খাবার। এসব খাবারে পুষ্টিমান কম। ২০১৭ সালের হিসাবে মোট খাদ্যশক্তির ৮০ শতাংশ সেই দানাদার জাতীয় খাদ্য থেকেই আসছে।

শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মানুষ প্রতিদিন যে খাবার খায়, তার মধ্যে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধের মতো পুষ্টিকর খাবার থাকে অর্ধেক। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে আছে।

তবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) পুষ্টি ইউনিটের পরিচালক মনিরুল ইসলাম মনে করেন, বাংলাদেশে পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি কম হওয়ার বড় কারণ হচ্ছে খাদ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব। মানুষ ভাত ও রুটি বেশি খাচ্ছে। তিনি বলেন, বাজারে সহজলভ্য সবজি, মাছ, ডিম ও দুধ বেশি করে খেলে পুষ্টি পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে।

দেশের পুষ্টি পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আরেকটি কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের দুধ ও মাংস খাওয়ার পরিমাণের দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম ১০০টি দেশের মধ্যে নেই।

ফিনল্যান্ডের মানুষ প্রতিদিন ৩৬১ মিলিলিটার ও সুইডেনে ৩৫৫ মিলিলিটার দুধ খায়। সেখানে বাংলাদেশের মানুষ খায় দিনে মাত্র ৩৩ দশমিক ৭ মিলিলিটার।

মাংস খাওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থা আরও খারাপ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৩টি দেশের মধ্যে ১৭২ তম। সবচেয়ে নিচে আছে ভারত, এই দেশটির বেশির ভাগ মানুষ ধর্মীয় কারণে গরুর মাংস খায় না।

হংকংয়ের মানুষ যেখানে প্রতিদিন ৪১৯ দশমিক ৬ গ্রাম ও অস্ট্রেলিয়ায় ৩১৮ দশমিক ৫ গ্রাম করে মাংস খায়। সেখানে বাংলাদেশের মানুষ খায় ১১ দশমিক ২৬ গ্রাম।

স্থূলকায় মানুষ বেড়েছে
ভারসাম্যহীন খাওয়ার কারণে স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

এফএওর ২০১৯ সালের বৈশ্বিক কৃষি পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৭ সালে যেখানে ১৮ বছরের বেশি বয়সী স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা ২০ বছরে তিন গুণের বেশি বেড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহিন বলেন, “আমরা শুধু কে কত বেশি খাবার খাচ্ছি আর কত বেশি উৎপাদন করতে পারছি, তা নিয়ে ভাবছি। কিন্তু কী খাচ্ছি, কতটুকু খাচ্ছি, কার কতটুকু খাওয়া দরকার, তা নিয়ে ভাবছি না।

কৃষি উৎপাদনে পুষ্টি চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে এগোতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

ধানগম নিয়ে শঙ্কা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রধান কৃষিজাত পণ্য ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ দাবি করলেও কোনো একটি দুর্যোগ হলে এবং ২ থেকে ৫ শতাংশ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলেই দেশে খাদ্যসংকট শুরু হয়ে যায়।

২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরে ২০ লাখ মেট্রিক টন ধানের উৎপাদন কম হয়। ২০১৭ সালে হাওরে হঠাৎ বন্যায় ৬ থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টন ধানের উৎপাদন কমে যায়। ওই দুই বছরই বাংলাদেশে চালের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়। তখন বিশ্বের খাদ্যঝুঁকিতে থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের উঠেছিল।

দেশে বছরে গম উৎপাদন হয় ১০ থেকে ১২ লাখ মেট্রিক টন। দুই বছর ধরে ব্লাস্ট রোগের কারণে গমের উৎপাদন দ্রুত কমছে। অন্যদিকে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের কারণে রুটি ও গম থেকে উৎপাদিত খাদ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।

গত এক যুগে দেশে গমের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬০ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানির প্রয়োজন হতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থার (ইউএসডিএ) প্রতিবেদনে এসেছে।

২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে গমের উৎপাদন কমে গিয়েছিল। ফলে গমের দাম বেড়ে যায়। সে সময় বাংলাদেশ সরকারও গম সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। তখন আটা-ময়দার দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

অবশ্য বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ বলেন, “আমাদের অবশ্যই পুষ্টিকর খাবার উৎপাদনের ওপর জোর দিতে হবে। এ জন্য কৃষিতে প্রযুক্তি ব্যবহার ও গবেষণা বাড়াতে হবে।”

Exit mobile version