Site icon Health News

মশাবাহিত রোগ: ভয় নয়, চাই সতর্কতা

আষাঢ় চলছে, বৃষ্টির সঙ্গে মশার উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মনে চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া রোগ নিয়ে আতঙ্কও ফিরে আসছে। মশাবাহিত এসব রোগ প্রতিরোধে মশা নিয়ন্ত্রণ এবং সতর্কতার উপরই গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত বছর রাজধানী ঢাকায় চিকনগুনিয়া আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছিল। যারা এতে ভুগেছিলেন, তারা এখনও সেই বেদনা ভুলতে পারেননি। তার আগে আতঙ্কের নাম ছিল ডেঙ্গু। ম্যালেরিয়া নির্মূল হয়নি এখনও।

হঠাৎ ভারি বর্ষণ এবং আসন্ন বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার বংশ বিস্তারের কারণে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট।

এক বার্তায় তারা বলেছে, এই অবস্থায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগ বিষয়ে আগাম সতর্কতা এবং এডিস মশা নির্মূলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া খুব জরুরি।

মশাবাহিত এসব রোগের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ হেলথ নিউজকে বলেন, “এসব রোগের ব্যাপারে আতঙ্ক নয়, দরকার সচেতনতা। কারণ এগুলো প্রতিরোধযোগ্য ও প্রতিকারযোগ্য রোগ। দরকার মানুষের সচেতনতা।”

আবহাওয়া বিবেচনা করলে মৌসুমী বৃষ্টিতে ডেঙ্গু ‍ও চিকনগুনিয়া ছড়ায়। এসব রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও এক বিজ্ঞপ্তিতে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছে।

রাজধানীতে ম্যালেরিয়া রোগীর বিনামূল্যে রক্ত পরীক্ষা ও ওষুধ দেবে অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। এজন্য মহাখালীর নিউ ডিওএইচএস (বাসা ২৪০, রোগ ১৭) জাতীয় নির্মূল কর্মসূচির কার্যালয়ে যেতে অনুরোধ করা হয়েছে।এছাড়া ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায়, যাদের বসবাস তারা অথবা পর্যটক স্থানীয় সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা, ওষুধ ও মশারি পাবেন।

ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত যে কোনো সেবার জন্য হটলাইন (+৮৮০১৭৮৭৬৯১৩৭০) নম্বরেও যোগাযোগ করার অনুরাধ জানিয়েছে অধিদপ্তর।

ডেঙ্গু

এক দশক ধরে নিয়মিতই ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে, এতে মারাও গেছেন অনেকে।

লক্ষণ: ডেঙ্গু হলে সাধারণত তীব্র জ্বর এবং সেই সঙ্গে শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। জ্বর ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটে উঠে যায়। এ ছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হতে পারে। শরীরে র‍্যাশ দেখা দেয়। এই জ্বরে অনেক ক্ষেত্রে বুকে বা পেটে পানি আসে। যকৃতে আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিসসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়। হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হলে দাঁতের মাড়ি, নাক, মুখ ও পায়খানার রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হতে পারে।

করণীয়: রোগীকে প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খাওয়াতে হবে এবং মশারির ভেতরে রাখতে হবে। জ্বরে শুধু প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যেতে পারে, কোনো অবস্থাতেই এসপিরিন জাতীয় ওষুধ সেবন করা যাবে না।

চিকুনগুনিয়া

গত বছর ঢাকা মহানগরে চিকুনগুনিয়া ‘মহামারি’ আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর থেকেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয় ঢাকায়। এ রোগে মৃত্যু না হলেও এর ভোগান্তি ব্যাপক।

 লক্ষণ: চিকুনগুনিয়ায় লক্ষণগুলো ডেঙ্গুর মতোই। আক্রান্ত হলে প্রচণ্ড জ্বরের পাশাপাশি শরীরে যন্ত্রণা হয় আর জ্বর সেরে যাওয়ার পরও গিঁটে গিঁটে অসহ্য ব্যথা হয়। এই জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক শক্তি কমে যায়। তারা স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা পর্যন্ত করতে পারে না।

 করণীয়: সাধারণত চিকুনগুনিয়া রোগটি এমনি এমনিই সেরে যায়, তবে কখনও কখনও গিটের ব্যথা কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছরও থাকতে পারে। গিটের ব্যথার জন্য ঠাণ্ডা পানির শেক এবং হালকা ব্যায়াম উপকারী হতে পারে।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশেনের ল্যাবরেটরি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী হেলথ নিউজকে বলেন, “নারীদের মধ্যে চিকনগুনিয়া বেশি হয়। বাঁচার জন্য সতর্ক হতে হবে।”

বর্ষাকালে শিশুদের হাফ প্যান্ট পরার বদলে ফুল প্যান্ট পরার পরামর্শ দেন দেন তিনি।

 ম্যালেরিয়া

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, ম্যালেরিয়া বাংলাদেশের একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় এবং মিয়ানমার ঘিরে থাকা সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ১৩টি জেলায় এ রোগের ব্যাপক বিস্তার রয়েছে।

গত বছর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে চলা কমনওয়েলথ সম্মেলনে বৈশ্বিক ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি নিম্নমুখী না হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা প্রাণঘাতী এ রোগের পুনরুত্থানের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।

ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেস এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ২১ কোটি ২০ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়।

মশা ও পরজীবীরা ম্যালেরিয়া রোধে ব্যবহৃত কীটনাশক ও ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় বিপদ বেড়েছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

লক্ষণ: অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা ম্যালেরিয়ার প্রধান লক্ষণ। জ্বর ১০৫-১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। তবে অনেক সময় নিয়মিত ও নির্দিষ্ট বিরতিতে জ্বর আসা-যাওয়া করে যেমন-একদিন পর পর জ্বর, তা তিন চার ঘণ্টা দীর্ঘ হওয়া এবং এরপর ঘাম দিয়ে জ্বর কমে যায়।

করণীয়: ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এই রোগ সম্পূর্ণ প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য। ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায় বেড়াতে গেলে, আগে থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বা ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ওষুধ সঙ্গে রাখতে হবে।

প্রতিরোধ পরিচ্ছন্নতাতেই

ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া তিনটি রোগই ছড়ায় মশার মাধ্যমে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার জন্য দায়ী এডিস মশা, ম্যালেরিয়া ছড়ায় অ্যানোফিলিস মশার মাধ্যমে। তাই মশা ঠেকালেই ঠেকানো যায় রোগ তিনটি।

মশার প্রজনন ক্ষেত্র বাসাবাড়িতে ফুলের টব, টায়ার, ফ্রিজ, এসিতে পানি জমতে দেওয়া যাবে না। এসব পরিষ্কারে নগরের প্রত্যেক নাগরিককে সচেতন হতে হবে। নিজ বাড়ির আঙিনা ও চারপাশও পরিষ্কার রাখতে হবে। মশার ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি ঘুমানোর সময় মশারি টানাতে হবে।

Exit mobile version